৩৪ নোবেল বিজয়ীর সাক্ষাৎকার
রতনতনু ঘোষ সম্পাদিত '৩৪ নোবেল বিজয়ীর সাক্ষাৎকার' একটি ব্যতিক্রমী গ্রন্থ। এ গ্রন্থ নোবেল বিজয়ীদের মননভাষ্য ও চেতনার বিশ্বলোক ধারণ করেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানসম্পদ ও উপলব্ধিলোকের পরিসর প্রসারের সহায়ক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। নোবেল বিজয়ীদের বহুমাত্রিক অনুভব, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান প্রয়াসের পরিচায়ক এ গ্রন্থ পাঠকদের মননসমৃদ্ধির ও জ্ঞানের ভুবন বিকাশের একটি আকরগ্রন্থ। দুইশত তেইশ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে সর্বমোট চৌত্রিশজন নোবেল বিজয়ীর দুর্লভ সাক্ষাৎকার একত্র করে প্রকাশিত। বইটিতে প্রত্যেক নোবেল বিজয়ীর ছবি এবং পরিচিতি প্রদান করা হয়েছে। সাহিত্য, শান্তি, অর্থনীতি ও বিজ্ঞান শাখার ক্ষেত্রে যাঁরা স্বনামধন্য এবং নোবেলজয়ী হিসেবে বিশ্বখ্যাত তাঁদের জ্ঞানভাষ্য গ্রন্থটিতে পরিবেশিত হয়েছে প্রশ্নোত্তর হিসেবে। বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে নোবেল বিজয়ীদের এসব সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল। সাক্ষাৎকারগুলোর বঙানুবাদ করেছেন অভিজ্ঞ অনুবাদকরা। অনুবাদকদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সাক্ষাৎকারগুলোর শেষাংশে। এছাড়া সাক্ষাৎকারগুলোর উৎস ও তথ্যনির্দেশ প্রকাশ করা হয়েছে যাতে গবেষকরা ব্যবহার করতে পারেন। গ্রন্থটি মননপ্রয়াসী পাঠক, সৃজনশীল সাহিত্যিক, গবেষক কৌতূহলী পাঠক ছাড়াও সর্বশ্রেণীর সাধারণ পাঠকের জন্য একটি বিশেষ আগ্রহের জ্ঞানবস্তু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আলবার্ট আইন স্টাইন, জজ বার্নাড শ, টি এস এলিয়ট, উইলিয়াম ফকনার, ফ্রাইসোয়া মারিয়াক, উইনস্টন চার্চিল, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, স্যামুয়েল ব্যাকেট, পাবলো নেরুদা, হেনরি কিসিঞ্জার, মাদার টেরিসা, গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেজ, উইলিয়াম গোল্ডিং, নাগিব মাহফুজ, দালাইলামা, অক্টাভিও পাজ, ড. আরনস্ট, নাদিম গার্ডিমার, ইয়াসির আরাফাত, টনি মরিসন, কেনজাবুরো ওয়ে, হোসে সারামাগো, অমর্ত্য সেন, গুন্টার গ্রাস, ভি এস নাইপল, ইমরে কার্তেজ, এলফ্রিয়েদ এলিনেক, হ্যারল্ড পিন্টার, ওরহান পামুক, ডরিস লেসিং, লা ক্লোজও ও জর্জ মারিয়ো পেদ্রো, ভার্সাস ইয়োসা প্রমুখ নোবেল বিজয়ীর সাক্ষাৎকার এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। এসব নোবেলবিজয়ী স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বসংস্কৃতির মানুষ হয়েও সমগ্র বিশ্বমানবের নিকট সশ্রদ্ধ পরিচয়ে গ্রাহ্য ও পাঠ্য। তাদের জ্ঞানমূলক প্রয়াস ও তৎপরতা বিশ্বব্যাপী পাঠক ও গবেষকদের আগ্রহের বিষয়। বাংলাভাষাভাষী পাঠকদের কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটাতে সক্ষম হবে 'চৌত্রিশ নোবেল বিজয়ীর সাক্ষাৎকার' শীর্ষক গ্রন্থটি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন দশ্তি। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির বিশ্বমুখশ্রী। তাঁর বক্তব্য হলো 'সত্য মার বিশ্বসভা একই, সেটি হলো মানবিক।' সত্যান্বেষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথোপকথন করেছেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ মানবীয় সত্যসন্ধানী আর আইনস্টাইন বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যান্বেষী। আইনস্টাইনের ভাষ্যমতে, 'আমরা যা কিছু করি বা যা কিছুর জন্য বেঁচে থাকি, সবই কার্যকারণের অধীন'। নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ'র উক্তি 'আমি কোনো বিশেষ পর্যায়ের প্রতি আকৃষ্ট নই।' তার সংগ্রামী জীবনালেখ্য ও দেশাত্মবোধক নাটক মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। সাক্ষাৎকার ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল। লেখাটি পত্রিকার পক্ষে হেয়ডর্ন চার্চ তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন যা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রবাদপ্রতিম আধুনিক কবি টিএস এলিয়টের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হল। তাঁর মতে 'আমি আমার অনুভূতিকে শব্দে ধারণ করতে পেরেছি।' উইলিয়াম ফকনার মার্কিন উপন্যাসিক। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জা স্টেইন। তার ভাষ্য হলো_ 'যে লেখক হতে চায় সে সমালোচনা পড়ে, আর যে লিখতে চায় সে কিন্তু ওই পথ মাড়ায় না।' তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সাহিত্যের নানা বিষয়ের আলোকপাত করেছে। কথাসাহিত্যিক ফ্রাঁসোয়া মারিয়াক নিজেকে একজন 'অধিবিদ্যাবিদ' হিসেবে পরিচয় দিতেন। সাহিত্য ও দর্শনের নানা বিষয়ে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন হাঁ লো মারশাঁদকে। তাঁর কথায় সাহিত্য প্রতিভা সর্বকালেই ক্রমক্ষয়িষ্ণু, অথচ দার্শনিকরা অভিজ্ঞতায় লব্ধ করেন সঞ্চয়ের ভা-ার'। বিশ্বসেরা রাজনীতিবিদ ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন গান্থার। তাঁর মতে, একটা যুদ্ধে সবসময় যে বিজয় অর্জিত হবে তার কোনো মানে নেই। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন সাক্ষাৎকারবিমুখ। তিনি নিজেও সাংবাদিকতা করেছেন। তবু মুখ খুলতেন না সাংবাদিকদের নিকট। কথোপকথন আকারে তার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত। কিংবদন্তিতূল্য বিশ্বনাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক শেনকার। বেকেট সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। গণবিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে তাঁর জীবনসত্য, সাহিত্য ও রাজনীতির উপলব্ধি। নিজেকে বিশাল মানবম-লীর অংশ করতে চেয়েছেন তিনি। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার কথোপকথন করেছেন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে। এতে তার ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর চিন্তা ও মন্তব্য প্রতিফলিত। মানবসেবার প্রতিভু মাদার তেরেসার সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন : 'ঈশ্বরের সৃষ্টি যেন আমাদের হাতে পড়ে নষ্ট না হয়।' ঈশ্বরের এ সৃষ্টি হলো মানুষ। ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মতে, 'লেখনীর তাড়না এসেছে স্মৃতিবিধূরতা থেকে।' তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ম্যানুয়েল এসোরিও। উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের মতে, 'ভালো লেখকেরা জন্মগ্রহণ করে, তৈরি হয় না।' মিসরীয় কথাসাহিত্যিক নাসিব মাহফুজ মুক্তবুদ্ধির প্রসারে আগ্রহী। তাঁর মতে, 'ধর্মীয় ব্যাখ্যা করতে হবে একটা মুক্ত সৃষ্টিকোণ থেকে।' প্যারিস রিভিউর পক্ষ থেকে তার এ দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন চারলোতে এল শাকস্নাভয়ে। তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামার মতে, 'আমাদের দিন অবশ্যই ফিরে আসবে।' বৌদ্ধ ধর্মীয় এ চৈনিক নেতা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মেক্সিকোর সাহিত্যিক অক্টাভিও পাজ মনে করেন 'সাহিত্য ক্ষেত্রে রুচি, দর্শন ও রাজনৈতিক মেরুকরণে কিছুটা মিল-অমিল মতোপার্থক্য তো থাকতেই পারে।' রসায়ন বিজ্ঞানী রিচার্ড আরনস্ট মনে করেন 'প্রয়োজন নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যার চালিকাশক্তি হবে বিজ্ঞান।' দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপন্যাসিক নাদিন গার্ডিমার লেখার মাধ্যমে আত্ম আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণকারী। কিংবদন্তীতুল্য বিশ্বরাজনীতিবিদ ইয়াসির আরাফাত শান্তি ও ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, 'আসুন, আমরা উদ্যোগী হই। যদি ইচ্ছা থাকে উপায় হবে।' কৃষ্ণাঙ্গ আমরিকান লেখিকা টনি মরিসন সবসময় সবার মধ্যে একজন হতে চেয়েছেন। জাপানের প্রকৃতি ও পরিবেশকেও যিনি সাহিত্যের বিষয় করেছেন সেই ঔপন্যাসিকের নাম কেনজাবুরো ওয়ে। তাঁর মতে সাহিত্য রচিত হওয়া উচিত প্রান্ত থেকে কেন্দ্রাভিমুখী। তাহলেই কেন্দ্রের সমালোচনা করা যাবে। ঔপন্যাসিক হোসে সারামাগোর ভাষ্যমতে 'নিষ্ঠুরতা মানুষের আবিষ্কার। প্রাণীরা একে অপরকে নির্যাতন করে না; কিন্তু আমরা করি'। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডোনজিলিনা। কৃতী বাঙালি ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রাবন্ধিক রতনতনু ঘোষ। অমর্ত্য সেনের মতে, 'ভূমিসংস্কার, সাক্ষারতা ও ক্ষুদ্রঋণের ব্যবস্থা ছাড়া কোনো দেশই বিশ্বায়নে সুফল আনতে পারবে না।' তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত। জার্মান ঔপন্যাসিক ওন্টারগ্রাস মনে করেন 'অশুভ রাজনীতি অনাচারের উৎস।' ভি.এস নাইপল লেখকও লেখনী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটিতে। তার মতে 'খারাপ বা দুষ্টু লোকের পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয়।' ঔপন্যাসিক ইমরে কার্তেজ মনে করেন, 'সন্ত্রাসবাদই হলো বিশ্বের জন্য বড় ধরনের হুমকি।' এ হুমকি বিশ্ব জনমতের ভিত্তিতে মোকাবেলা করতে হবে। সাক্ষাৎগুলোর অন্তর্লোকে প্রবেশ করলে পাঠক পাবেন অনেক কিছুর সন্ধান। ৩৪ নোবেল বিজয়ীর সাক্ষাৎকার। সম্পাদনা : রতনতনু ঘোষ। প্রকাশক : সাহিত্য বিলাস। প্রচ্ছদ : মোবারক হোসেন লিটন। প্রকাশকাল : একুশে বইবেলা-২০০১। মূল্য : দুইশত টাকা মাত্র। ড. ছন্দশ্রী পাল
http://www.jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=30-4-2011&feature=yes&type=single&pub_no=81&cat_id=3&menu_id=23&news_type_id=1&index=1
|